Wednesday, December 19, 2018

হযরত রুহুল আমিন বশিরহাটী রহমতুল্লাহি আলাইহির ইলিম বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা


মুহম্মদ নূরে জুলফিকারঃ হাফিযে হাদীছ, মুফতীয়ে আযম হযরত রুহুল আমিন বশিরহাটী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ইলিম বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।

আফসোস সেইসব বাংলা ভাষা-ভাষী মুসলমানদের জন্য, যারা হযরত রুহুল আমীন বশিরহাটী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নামই জানে না। উনার ইলমি বিষয়গুলো যদি আজ আরবীতে লিখতেন তবে আরব, মিশর, লেবানন থেকে প্রকাশ করার জন্য হুমড়ী খেয়ে পড়তো। অথচ আমাদের বাংলাভাষী মানুষ যারা আছেন তারা কয়জন উনার নাম জানেন? না জানার কারনে ভ্রান্ত বাতিল ফির্কা আজ অনেক সুযোগ নিয়ে যাচ্ছে।

হযরত রুহুল আমীন বশিরহাটী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ইলমি যোগ্যতা এমন ছিলো যে, প্রথম বর্ষ থেকে শেষ ক্লাস পর্যন্ত প্রথম স্থান উনার দখলে ছিল। জমাতে উলায় সারা বাংলা আসামের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে মেডেল প্রাপ্ত হন। সমস্ত ক্লাসের কোন বিষয়ের পরীক্ষার খাতায় কোন পরীক্ষক একটি নম্বরও কাটতে পারতেন না। পৌনে দুশত বৎসরের মাদ্রাসার ইতিহাসে এমন ছাত্রের আর দ্বিতীয় হদিস পাওয়া যায় না। তিনিই কেবল নজীর বিহীন দৃষ্টান্ত (রেকর্ড) রেখে গেছেন। কেন হবে নামাত্র ১৪ দিনে পাগঞ্জ নামক দুরুহ কিতাবখানা সম্পূর্ণ মুখস্থ করেছিলেন। উনার সহপাঠিদের তিনি মুনশীনা করে পড়াতেন। কিতাবের হাশিয়া (পদ টীকা) পর্যন্ত মুখস্থ করতেন। অধ্যাপকদের ভাষণ শ্রবণ করেই মুখস্থ করে ফেলতেন। পরীক্ষার খাতায় হাশিয়া পর্যন্ত্র উদ্ধৃতি দিতেন।

মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা বজলুর রহমান সাহেব দরগাহপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমার প্রচার জীবনের প্রথম দিকে একখানা বিখ্যাত তফসীর সব সময় কাছে রাখতাম। মাঝে মাঝে পড়তাম ও ওয়াজ করতাম। একদিন আল্লামা রুহুল আমিন সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হেড মৌলভী সাহেব! রোজ রোজ কি দেখেন? দেখি, তিনি কিতাবখানা একবার মাত্র দেখে নিয়ে বলেন, “আমার পাঠ্য জীবনে সব মুখস্থ ছিল, অনেক দিন হয়ে গেল, একটু দেখে নিলাম। এবার শুনেন দেখি। এই বলে আল্লামা বশিরহাটী রহমতুল্লাহি আলাইহি গড় গড় করে মুখস্থ পড়ে যেতে লাগলেন। এমনি আশ্চর্য ধরণের মেধা শক্তি ছিল উনার। আল্লামা বশিরহাটী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলতেন, আমি যা ২/১ বার পড়েছি, মহান আল্লাহ পাক তা আমাকে সবই মুখস্থ করে দিয়েছেন।

তিনি হাদিস শরীফের হাফেজ ছিলেন। মুম্বাইয়ের জামে মসজিদের ইমাম সাহেব, আল্লামা রুহুল আমীন বশিরহাটী রহুমতুল্লাহি আলাইহির ওয়াজ শুনে অত্যন্ত প্রীত হয়ে উনার পিঠে হাত বুলিয়ে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আপনারা কোরআনের হাফেজ অনেক দেখেছেন কিন্তু হাদিসের হাফেজ দেখেন নাই।। অদ্য হাদিসের হাফেজ দেখুন। মাদ্রাসা আলিয়ার সুযোগ্য অধ্যাপক মাওলানা বেলায়েত হোসেন সাহেবের ব্যবস্থাপনায় নোয়াখালী জেলার দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা মক্কা ও মদিনা শরীফের শিক্ষা প্রাপ্ত জনাব কারী বসির উল্লাহ সাহেবের নিকট এমে কেরাত আদী প্রান্ত শিক্ষা করেন এবং শরহে জজরীনামক কিতাবখানাও পড়েন। স্বনামধন্য বাসিরউল্লাহ সাহেবের কেরাত পাঠ শ্রবণে মানুষ মুগ্ধ হয়ে যেতেন। এমন কি মনে করতেন ঘরের ছাদ খসে পড়ে যাবে।

বিখ্যাত আলেম, হযরত মাওলানা মীজুদ্দিন হামিদী সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ১৩২৩ সালের ৮ই চৈত্র পীর হযরত মাওলানা গোলাম সালমানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ঈছালে ছওয়াবের মহফিলে ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দেদ, পীর কেবলা এরশাদ করেন,-“আমার খান্দানে এলমে লাদুন্নির ফয়েজ আছে, আমি উহা মাওলানা রুহুল আমিন রহমতু্ল্লাহি আলাইহি উনাকে দিয়েছি। এ থেকে তার যোগ্যতা অকাট্যরূপে প্রমাণিত হয়। ফুরফুরার পীর কেবলা উনাকে বড় মাওলানালকব দিয়েছিলেন এরং ভুয়সী প্রশংসা করতেন।

আল্লামা রুহুল আমিন বশিরহাটী রহমতুল্লাহি আলাইহি কেবল পাঠ্য পুস্তকে সীমাবদ্ধ জ্ঞানে সন্তুষ্ট ছিলেন না। অবসর সময়ে তিনি জনাব খোদাবক্স সাহেবের কিতাবের দোকানে বসে বসে পুরাতন গুরুত্ব পূর্ণ কিতাব সংগ্রহ করতেন। বাংলা-আসামের বিভিন্ন স্থানে কেবল নয়, পবিত্র হজ্বের সময় মক্কা মুয়াজ্জেমা ও মদিনা মুনাওয়ারা থেকেও চারিশত কিতাব এনেছিলেন। তাছাড়াও মিশর, বায়রুত, হালাব, মরক্কো, পাটনা, হায়দারাবাদ ও হিন্দুস্থানের বিভিন্ন স্থান থেকে দূর্লভ ও দৃপ্রাপ্য ন্যায়ের কিতাব সংগ্রহ করেন এবং রেজিষ্টারকৃত দলিলে কুতুবখানা দ্বীন সমাজের খেদমতের জন্য ওয়াকফ করে গেছেন। সংগৃহীত কিতাবগুলি আদ্য প্রান্ত পড়েছেন এবং বিশেষ বিশেষ স্থানে প্রয়োজন মত নিশানা দিয়েছেন। খ্যাতনামা তেজস্বী আলেম, পীরজাদা, মাওলানা আবুল হুসাইন নোমানী সাহেব বলেন, আমি বসিরহাটের আল্লামার লাইব্রেরী দেখতে যেয়ে কিতাবের নামের তালিকায় দেখলাম, অভিধানের সংখ্যা চল্লিশখানা, আমি এ দেখেই বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, যাঁর সংগ্রহশালায় ৪০ খানা অভিধান, তিনি কোন ধরণের প্রজ্ঞাবান কিতাব ছিলেন। কিতাবের নামের তালিকার জন্য ৪২ দিস্তা কাগজ লেগেছিল।

আল্লামা রুহুল আমিন রহমতু্ল্লাহি আলাইহি সংগৃহীত কিতাবের সংখ্যা সঠিক ভাবে না পেলেও অসংখ্যক কিতাবকে মূলধন করে তিনি যে অমূল্য গ্রন্থাবলী রচনা করে গেছন। সে সময় সে দৃষ্টান্ত বাংলা-আসামের কোন আলেমের পক্ষে দ্বিতীয়তঃ সম্ভব হয়নি। জনাব মুবারক আলী রহমানী সাহেব বলেন, আল্লামার প্রণীত প্রায় ৮০/৮৫ খানা কিতাব পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে, দ্বীন-হীন লেখকের আল্লামার লিখিত প্রায় ৮/১০ খানা কিতাব পড়ার খোশ নছীব হয়েছে। তৎপ্রণীত গ্রন্থে তিনি যে সব কিতাবের হাওলা (উদ্ধতি) দিয়েছেন, সে সব কিতাবের নাম বর্তমান আলেমদের জানা নাই বলিলে ভুল হবে না। জনাব মুবারক আলী রহমানী সাহেব বলেন, মাদ্রাসা আলিয়ার একজন আলেমের সাথে কোন একটা মসলা নিয়ে মত বিরোধ হওয়া আলেম সাহেব, বসিরহাটের আল্লামার মতকে অস্বীকার করলে, আমার ওস্তাদ কেবলার পরামর্শে কিতাবের তালিকা থেকে মাত্র ১০ খানা কিতাবের নাম দিয়ে এতটুকু বলে দিয়েছিলাম যে মাদ্রাসার গোটা স্টাফ ঐ ১০ খানা কিতাব কোন বিষয়ের কিতাব, লেখকের নাম কি? কত সনে কোথায় মূদ্রিত, বলতে পারলে আপনাদের মত মানবো। শুনলে খুশী ও অবাক হবেন, আলেম সাহেবগণ শত চেষ্টা করেও মাত্র ১ খানা কিতাবের নাম বলতে পেরে স্বীকার করেছিলেন, ঐ একখানা কিতাবের নাম শুনেছি কিন্তু চোখে দেখিনি।

অনেক বক্তা ও অনেক কিতাবের লেখক আছেন, যারা মূল কিতাব না দেখে, অন্যের থেকে ধার করা স্বরূপ নিছক দায় সারা গোছের হাওলা দিয়ে থাকেন। কিন্তু এখানে আল্লামার স্বতন্ত্র বৈশিষ্টতা ছিল। যা সকলের মধ্যে পাওয়া যায় জন্ম গ্রহণ করেন। না। মূল কিতাব রচয়িতার নাম, খণ্ড, পৃষ্ঠা ও উদ্ধৃতি দিতেন। পূর্বেই বলেছি এমন মানুষ হাজারে বা লক্ষে একজন, শতাব্দীতে ২/১ জন। আল্লামার সংগৃহীত সমস্ত কিতাবের বিস্তারিত আলোচনা করার অবকাশ না থাকায়, সংক্ষেপে তৎপ্রণীত কিতাব থেকে রহমানী সাহেব

যে হাজার খানার মত কিতাবের তালিকা ভুক্ত সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহা হইতে আপাততঃ কিছু সংখ্য তত্ত্ব আপনাদের উপহার দিলাম। তফসির৫১খানা, হাদিসউসুলে হাদিস ১০৫ খানা, ফেকাহ২৭৫ খানা, লোগাত১৮ খানা, আসমাউর রেজাল৬০ খানা, তারিখ৫৫ খানা, অন্যান্য বিষয়ের ৩৪০ খানা। এ ছাড়াও ভিন্ন মতালম্বীদের কিতাব যথা কাদিয়ানী মতের৫৪ খানা, শিয়া মতের১০ খানা, খৃষ্টান মতের৮ খানা, হিন্দুদের১৬ খানা কিতাবের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়।

আল্লামার যোগ্যতা ও সম্যক পরিচয় পাওয়ার পরিপূর্ণ সুযোগ। তাঁর তৎপ্রণীত (লিখিত) গ্রন্থাবলীর মাধ্যমে। তাকে চির অমর করে রেখেছে তার অমূল্য সম্পদ গ্রন্থাবলীই।

পীর কেবলা মুজাদ্দেদে জামান ফুরফুরাবী, তাকে কাদেরীয়া তরিকার ফয়েজ দিয়েছিলেন, এ তারই প্রতিবিদ্ধ। মক্কা মুয়াজ্জমায় বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় দীর্ঘ সাড়ে তিন চার ঘন্টা ওয়াজ করার দৃষ্টান্ত বাঙ্গালী কেন, কোন ভারতীয় আলেম অদ্যাবধি স্থাপন করতে পারেনি। আরবের বড় বড় মুহাদ্দেছরা কেবল ধুমপান ও দাড়ি মুগুণ সম্বন্ধে প্রায় সাড়ে তিনশ হাদিসের উদ্ধৃতি শুনে অবাক হয়েছিলেন।

এই হলো উনার ইলমী যোগ্যতার মধ্যে অল্প কিছু দৃষ্টান্ত। প্রকৃতপক্ষে উনার যোগ্যতা ছিলো আরো উর্ধে। আল্লাহ পাক আমাদের হক্কানী উলামায়ে কিরাম উনাদের মূল্যায়ন করার তৌফিক দান করুন । আমীন


শেয়ার করুন

0 facebook: